বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম দলের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি বণিক বার্তার প্রতিবেদক মিজানুর রহমান হেলাল-এর সঙ্গে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে বলেন সাম্প্রতিক নানা প্রসঙ্গে -এর সঙ্গে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে বলেন সাম্প্রতিক নানা প্রসঙ্গে সংসদের আগামী অধিবেশনে যোগ দেবে বিএনপি? বিএনপি সংসদে যেতে চায়। তবে তার আগে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল আনতে হবে। আমাদের সংসদ সদস্য ও তৃণমূল নেতাকর্মীদেরও এটাই দাবি। আর বিল যদি না আনা হয়? সে ক্ষেত্রে বিএনপি সংসদে যাবে কি যাবে না— সে সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। আওয়ামী লীগের দাবি আপনারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করছেন। আসল সত্যটা কী? যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমরাও চাই। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছিলেন। তার দল হিসেবে বিএনপি অবশ্যই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। তবে আমরা চাই বিচার স্বচ্ছ, বিশ্বাসযোগ্য ও আন্তর্জাতিক মানের হোক। রাজনৈতিকভাবে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য প্রহসনের বিচার যেন না করা হয়। এখানে প্রশ্ন আসছে জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামী প্রসঙ্গে। ১৯৮৬ সালে এরশাদ যখন নির্বাচন দেন, তখন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে বলেছিলেন, ‘যারা এরশাদের অধীনে নির্বাচন করবেন, তারা জাতীয় বেইমান!’ এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত বদলে জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে ওই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল এবং এর মাধ্যমে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারকে বৈধতা দিয়েছিল। ১৯৯৫-৯৬ সালে আওয়ামী লীগ কিন্তু জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছিল। তত্ত্বাবধায়ক ধারণাটি জামায়াতে ইসলামীর মস্তিষ্কপ্রসূত। অনেক জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিএনপির আগের মেয়াদে (১৯৯১) তত্ত্বাবধায়ক সরকার চালু হলেও সেটি লালন-পালন করেছে আওয়ামী লীগ। তখন আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলেনি। এরপর আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল (১৯৯৬-২০০১) তখনো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলেনি। স্বাধীনতার পর যখন শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে নতুন সরকার গঠন করলেন, তখন মূল যুদ্ধাপরাধী ১৯৫ জন সেনাকর্মকর্তাকে ত্রি-দেশীয় চুক্তির মাধ্যমে ছেড়ে দিলেন। যাদের সহযোগী হিসেবে ধরা হয়েছিল, তাদের জন্যও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। জামায়াত যে যুদ্ধাপরাধী, সেটি তখন আওয়ামী লীগের মুখে উচ্চারিত হয়নি। ফলে আওয়ামী লীগ সত্যিই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় নাকি— ইস্যুটিকে জাগিয়ে রেখে পরবর্তী নির্বাচনে ফায়দা লুটতে চায়; তা নিয়ে জনমনে সন্দেহ আছে। জামায়াতকে শরিক দল করতে এ ধরনের হুমকি দেয়া হচ্ছে কি না সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আপনারা বলছেন বর্তমান সরকার দুর্নীতিতে আগের সব সরকারকে ছাড়িয়ে গেছে। কীসের ভিত্তিতে বলছেন? ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যর ভিত্তিতেই বলছি। দেশের সব ব্যবসা-বাণিজ্য সরকারি দলের লোকরা পকেটে পুরেছেন। গত চার বছরে মন্ত্রী, এমপি, শাসক দলের নেতা ও তাদের আত্মীয়স্বজন বড় বড় ব্যবসা-বাণিজ্য নিজেদের দখলে নিয়েছেন। বেসরকারি ব্যাংক, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, টিভি চ্যানেল, বিদ্যুত্, টেলিফোন, জাহাজ নির্মাণ থেকে শুরু করে নতুন ব্যবসার একচেটিয়া লাইসেন্স নিয়েছেন তারা। বড় বড় টেন্ডার বাগিয়ে নিয়েছেন। ৫৬টি বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের চুক্তি হয়েছে। যেখানে জনগণের পকেট থেকে প্রতি বছর ৩০-৩৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। বিনা টেন্ডারেই এগুলো করা হয়েছে। জনগণের টাকা লুটপাট করছেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপি ও নেতাকর্মী এবং তাদের আত্মীয়স্বজনরা। এ সরকারের আমলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৬টি। আওয়ামী লীগের দুই শাসনামলে ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২১টি। আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ের লাইসেন্স পেয়েছে ৪২টি প্রতিষ্ঠান। অবৈধ ভিওআইপির মাধ্যমে প্রতি বছর ২ হাজার কোটি টাকার বেশি লুণ্ঠন হচ্ছে। পদ্মা সেতু, হলমার্ক, ডেসটিনি, ইউনিপেটুইউ, নৌবন্দর, জলবায়ু তহবিল— সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জন্য একজন সম্পাদককে জেলে পোরা হয়েছে। এ দুর্নীতির খবর নিশ্চয় সত্য। না হলে এ অত্যাচার কেন নেমে আসবে? এ সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ আপনাদের কাছে আছে কি? শতভাগ সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ আমাদের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের কাছে আছে। আমি খাত নির্দিষ্ট করে বলছি। যেমন রেল খাতে সুরঞ্জিত বাবুর এপিএস টাকা নিয়ে ধরা পড়লেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি নিয়ে সেতু বিভাগের সচিবসহ অনেকের বিরুদ্ধে মামলা করল দুদক। এখানে প্রশ্ন হলো, কর্মকর্তাদের কী ক্ষমতা আছে এসব ঘটানোর? মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তির সমর্থন ছাড়া এ দুর্নীতি করা আদৌ সম্ভব কি না এটা ভাবার বিষয়। তারেক রহমান দেশে ফিরছেন কি না? ফিরলে কবে নাগাদ? এ প্রসঙ্গে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। তারেক রহমানের রক্তে রাজনীতি মিশে আছে। তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। অবশ্যই তিনি দেশে আসবেন। শুধু সময়ের অপেক্ষা। আমরা যত বেশি আন্দোলন করব, সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করব, তার দেশে আসার পথ তত সুগম হবে। খালেদা জিয়ার নামে মামলা চলছে। তার সাজা হলে আপনাদের করণীয় কী হবে? আমরা সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নেব। দলের প্রাণশক্তি হচ্ছে তৃণমূল নেতাকর্মী। কোনো অবস্থাতেই তারা এটা মেনে নেবেন না। এ ধরনের অযৌক্তিক, অনৈতিক সিদ্ধান্ত যদি সরকার নিয়ে থাকে, তাহলে দেশে চরম নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে। কারণ ২০০৭ সালে তত্কালীন সেনাসমর্থিত সরকার খালেদা জিয়া-শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে বেশি দিন কিন্তু ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। এ থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। সে সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নামে ১৩টি দুর্নীতির মামলা হয়েছিল, যার সবকটিই বর্তমান সরকারের আমলে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোসহ বিএনপি নেতাকর্মীর নামে ওই সময়ে যেসব মামলা দেয়া হয়েছিল, তার একটিও প্রত্যাহার করা হয়নি, বরং নতুন-নতুন মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। বিএনপি নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ কোনো অবস্থায়ই এটা মেনে নেবে না। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের পথ কী? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনেকগুলো নির্বাচন হয়েছে। সর্বশেষ যে নির্বাচন হয়েছে, সেটি ছিল একটি অসাংবিধানিক অবৈধ সরকারের অধীন। এটাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলা যাবে না। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সব নির্বাচনই আওয়ামী লীগ, বিএনপি কম-বেশি মেনে নিয়েছে। আজকের এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমস্যা আওয়ামী লীগেরই সৃষ্টি। তাই সমাধান করার দায়িত্বও তাদেরই। এটা সমাধানের একমাত্র উপায় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল এনে নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প কিছু হতে পারে কি না? নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন আমরা তা মেনে নিতে রাজি। কিন্তু আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে আমরা কিছুতেই অংশ নেব না। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সংলাপের প্রস্তাব পেলে কী করবেন? তারা আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব আগে দিক। তারপর এ নিয়ে বলা যাবে। আগে থেকে কিছু বলা ঠিক হবে না। প্রস্তাব বিবেচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল সংসদে উত্থাপন করলে আমরা সংলাপে বসতে রাজি আছি। আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে বলুন। আমাদের আন্দোলনের পাশাপাশি নির্বাচনে কে কে প্রার্থী হবেন, তা ঠিক করার প্রক্রিয়াও চলছে। আমরা থেমে নেই। তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মতামত নিয়ে আমরা প্রার্থী ঠিক করব। প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এবার বড় ধরনের রদবদল হবে কি না? প্রয়োজন হলে করব। ৩০০ আসনে প্রার্থী ঠিক করতে আমাদের জরিপ চলছে। তৃণমূল পর্যায়ে কার অবস্থা কেমন— সে ব্যাপারে খোঁজ নেয়া হচ্ছে। গ্রাম, ইউনিয়ন, থানা পর্যায়ের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মতামত নিচ্ছি। অবশ্যই আমাদের নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়লাভের ব্যাপারে আপনারা কতটা আশাবাদী? আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় দিন দিন ধস নামছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুত্-গ্যাস-পানিসংকট, প্রতিটি খাতে সীমাহীন দুর্নীতি, শেয়ারবাজার ধস, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, খুন, গুম, ধর্ষণ, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি— সব মিলে বাংলাদেশ মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম ক্রমেই মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বাড়িভাড়া আকাশচুম্বী হওয়ায় সাধারণ মানুষের পক্ষে বাসা ভাড়া করে ঢাকায় বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এসব কারণে সরকারের ওপর সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ। কাজেই সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জনগণ আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করে বিএনপির পক্ষে রায় দেবে।
সুত্র:- দৈনিক বণিক বার্তা / শনিবার, জানুয়ারি ৫, ২০১৩, পৌষ ২২, ১৪১৯