রাস্তায় টহল দিচ্ছেন তালেবান যোদ্ধারা - ছবি : এএফপি

আফগানিস্তানে আবার ক্ষমতা দখল করার পথে তালেবান

ডেস্ক : প্রায় দুই দশক পর আফগানিস্তানে আবার ক্ষমতা দখল করার পথে এগোচ্ছে তালেবান। দেশটি থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরু হওয়ার পর একের পর এক এলাকা দখল করছে তালেবান বাহিনী। ১৩ আগষ্ট শুক্রবার পর্যন্ত দেশটির অর্ধেকের বেশি প্রাদেশিক রাজধানীর পতন ঘটেছে তালেবানের হাতে। অনেক এলাকায় আফগান সরকারি বাহিনীর সঙ্গে তাদের লড়াই চলছে। রাজধানী কাবুল দখলের পথে এগোচ্ছে তারা। ইতিমধ্যে কাবুল থেকে মাত্র ৩০ মাইল দূরে পৌঁছে গেছে তালেবান বাহিনী।

কাতারের রাজধানী দোহায় আফগান সরকার ও তালেবানের প্রতিনিধিদের নিয়ে গত বৃহস্পতিবার বৈঠক করেছেন বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকেরা। এরই মধ্যে আফগান সরকার তালেবানকে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রস্তাব দেয়। তবে তালেবান তা নাকচ করে দেয়। এ বিষয়ে শুক্রবার পর্যন্ত নতুন কোনো তথ্য জানা যায়নি।

এই পরিস্থিতিতে দুই পক্ষের লড়াইয়ে ভীতসন্তস্ত্র সাধারণ মানুষ প্রাণভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছে। অনেকে নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় কাবুলে পৌঁছে রাস্তা, পার্ক ও ফাঁকা জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে।

এদিকে তালেবান বাহিনী দ্রুতগতিতে কাবুলের দিকে অগ্রসর হওয়ায় শহরটি থেকে বিভিন্ন দেশ নিজেদের নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য আফগানিস্তানে নতুন করে সেনা পাঠানো শুরু করেছে। এরই মধ্যে বেশ কিছু মার্কিন সেনা কাবুলে পৌঁছেছে।

আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রাদেশিক রাজধানীর মধ্যে ১৩ আগষ্ট শুক্রবার পর্যন্ত ১৮টিই দখল করে নিয়েছে তালেবান। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কান্দাহার ও তৃতীয় বৃহত্তম শহর হেরাত এখন তালেবানের দখলে। গতকালও কয়েকটি শহর দখলে নেয় তালেবান। নতুন দখল করা শহরগুলোর মধ্যে রয়েছে কালাত, তেরেনকোট, পুল-ই-আলম, ফিরুজ কোহ, কালা-ই-নাও ও লস্করগাহ। এর মধ্যে লগার প্রদেশের রাজধানী হলো পুল-ই–আলম। এই শহর কাবুল থেকে মাত্র ৩০ মাইল দূরে। প্রাদেশিক রাজধানীগুলো দখলের পর তালেবান বাহিনী এখন কাবুল দখলের লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে।

এদিকে সরকারি বাহিনী ও তালেবান যোদ্ধাদের লড়াইয়ের বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। জাতিসংঘের তথ্যমতে, সংঘাতে শুধু গত মাসেই ১ হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছে। যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ বাড়িঘর হারিয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে সংঘাতপূর্ণ এলাকা ও শহরগুলো থেকে হাজারো সাধারণ মানুষ নিরাপদে আশ্রয়ের আশায় রাজধানী কাবুলের দিকে ছুটছে। বাস্তুচ্যুত সাধারণ মানুষের জন্য আশপাশের দেশগুলোকে সীমান্ত খোলা রাখার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ।

যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, বাড়িঘর হারিয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা লোকজন কাবুলের সড়ক, পার্ক ও ফাঁকা স্থানগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে মানবেতর জীবন যাপন করছে তারা। আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চল কুন্দুজ দখলের পর তালেবানের আগুনে বাড়িঘর হারিয়ে পরিবার নিয়ে কাবুলের সড়কে আশ্রয় নিয়েছেন আসাদুল্লাহ। গতকাল বিবিসিকে তিনি বলেন, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শুধু প্রাণটা নিয়েই কাবুল পৌঁছাতে পেরেছেন। তাঁদের কাছে কোনো অর্থ নেই। রুটি, শিশুদের প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধ কেনারও সামর্থ্য নেই। আসাদুল্লাহ আরও বলেছেন, ‘আমাদের সব বাড়িঘর ও জিনিসপত্রে আগুন দেওয়া হয়। তাই আমরা কাবুলে এসেছি, সাহায্যের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি।’

বাস্তুহারা মানুষের চাপ সামলাতে কাবুলের উপকণ্ঠে ফসলি জমিতে অস্থায়ী আশ্রয়শিবির গড়ে তোলা হয়েছে। অনেকে পরিত্যক্ত গুদামে আশ্রয় নিয়েছে। বাড়িঘর হারানো এসব মানুষের চোখে-মুখে হতাশা আর ভয়ের ছাপ। সঙ্গে তাড়া করে ফিরছে সামনের দিনগুলোতে তাদের ভাগ্যে কী ঘটতে চলেছে, তা নিয়ে।

আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের তথ্যমতে, সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে পালিয়ে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে ৭২ হাজারের মতো শিশু। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) সতর্ক করে বলেছে, সংঘাতের কারণে আফগানিস্তানে চরম খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। সেখানে অচিরেই মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।

অপরদিকে সংঘাত থামাতে ও শান্তিপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে নানামুখী কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও চলছে। রয়টার্সের খবরে বলা হয়, কাতারের রাজধানী দোহায় আফগান সরকার ও তালেবানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ কয়েকটি দেশের কূটনীতিকেরা। বৈঠকের পর বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে আফগানিস্তানে শান্তিপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি প্রাদেশিক রাজধানী ও অন্য শহরগুলোতে হামলা বন্ধ করার দাবি জানানো হয়। বৈঠকে পাকিস্তান, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। আলোচনায় সব পক্ষই আফগান সংকটের কার্যকরী রাজনৈতিক সমাধানের দাবি জানায়।

এদিকে তালেবানকে সহায়তার অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তিনি বলেন, ইসলামাবাদ রাজনৈতিকভাবেই আফগানিস্তান সংকটের সমাধান চান।

আফগানিস্তানের পরিস্থিতি উপলব্ধি করেই কাবুল থেকে দূতাবাসের কর্মী ও নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিবিসি জানিয়েছে, মার্কিন নাগরিকদের সরিয়ে নিতে কাবুলে নামতে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা। এর আগে ৩ হাজার সেনা কাবুলের পাঠানোর ঘোষণা দেয় পেন্টাগন। গতকাল পেন্টাগনের মুখপাত্র জন কিরবি সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেছেন, তালেবানের অগ্রসর রুখতে বিমান হামলা চলবে।

কাবুলে বিদেশি মিশনগুলোতে তালেবান হামলার শঙ্কার বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস গণমাধ্যমকে বলেন, ‘তালেবান নিজেরাই বলেছে, কোনো কূটনৈতিক স্থাপনায় হামলা চালাবে না। কিন্তু তালেবান যা বলছে, তা আমরা বিশ্বাস করছি না।’

যুক্তরাজ্যও আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে। বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ৬০০ সেনা পাঠানো হবে। তারা আফগানিস্তানে থাকা ব্রিটিশ নাগরিকদের নিরাপত্তা ও অন্যান্য সহায়তা দেবে। এই ঘোষণার পরদিন গতকাল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন জানিয়েছেন, কাবুলের দিকে তালেবানের অগ্রসর ঠেকানোর বিষয়ে সামরিক সমাধান নেই। আফগানিস্তানে নিজ দেশের স্বার্থরক্ষায় দৃঢ় পদক্ষেপ নেবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

তালেবানকে ঠেকাতে যতটা সম্ভব আফগান সরকারকে সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সামরিক জোট ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, কাবুলে ন্যাটোর কূটনৈতিক কার্যক্রম বজায় রাখা হবে।

নাইন-ইলেভেনে যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ের নামে আফগানিস্তানে অভিযান চালায় মার্কিন বাহিনী। দেশটির ক্ষমতায় থাকা তালেবান সরকারকে উৎখাত করে তারা। অনেকের চোখে চরম কট্টরপন্থী বলে পরিচিত তালেবান তখন থেকেই মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। সেই ঘোষণা অনুযায়ী সেনা প্রত্যাহার শুরু হয়। এদিকে আফগানিস্তানের পুরো দখল নিতে অভিযান জোরদার করে তালেবান।

আরো খবর ➔
বাংলাদেশে ২০ জেলায় বন্যার আশংকা