মিজানুর রহমান হেলাল
দর্শক টানতে ব্যর্থ হচ্ছে দেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। ক্যাবল অপারেটরদের হিসাবে, ৭০ শতাংশ সময়ই বিদেশী চ্যানেলে আটকে থাকছে দর্শক। তার পরও অনুষ্ঠানের মানোন্নয়ন না ঘটিয়ে উল্টো বাজার দখলের মানহীন প্রতিযোগিতায়ই বেশি মনোযোগী দেশী চ্যানেলগুলো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কোনো দেশের টেলিভিশন চ্যানেলকেই এখন প্রতিযোগিতা করতে হয় বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে। দর্শকপ্রিয়তা পেতে তাই আন্তর্জাতিক মানের অনুষ্ঠান সম্প্রচারের বিকল্প নেই। আর দর্শক রুচি বিবেচনায় নিয়ে অনুষ্ঠান করতে গেলে বিনিয়োগের বিষয়টিকেও প্রাধান্য দিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, দর্শকদের দেশী চ্যানেলের প্রতি আকৃষ্ট করতে সবার আগে প্রয়োজন তাদের রুচি সম্পর্কে জানা। এজন্য নিয়মিত দর্শক জরিপ পরিচালনা করতে হবে। সে অনুযায়ী নির্মাণ করতে হবে মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান। পাশাপাশি ভালো অনুষ্ঠান নির্মাণে বিনিয়োগ ও গবেষণাও বাড়াতে হবে।
প্যারিসভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডাটাক্সিস বলছে, দ্রুত বড় হচ্ছে দেশে খাতটির বাজার। ২০১২ সালে দেশে ক্যাবল টিভির বাজার ছিল প্রায় ৬৬০ কোটি টাকার। ২০১৮ সালে এর আকার দাঁড়াবে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকায়।
বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এফটিএ (ফ্রি টু এয়ার) সার্ভিসভিত্তিক হওয়ায় বিজ্ঞাপনই তাদের আয়ের একমাত্র মাধ্যম। বিজ্ঞাপন সংস্থা অ্যাডকমের হিসাবে, দেশের টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের বাজার বাড়ছে প্রতি বছর ১৫-২০ শতাংশ হারে। বহুজাতিক বিভিন্ন কোম্পানি, টেলিকম খাতের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও দেশের বড় কয়েকটি করপোরেট গ্রুপ এ বিজ্ঞাপনের প্রধান উত্স।
বিজ্ঞাপনের এ বাজার ধরতে এক ধরনের মানহীন প্রতিযোগিতার মধ্যে রয়েছে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। অনেক সময়ই মনগড়া ও বিজ্ঞানবিরুদ্ধ বিজ্ঞাপন প্রচার করছে তারা। বেশিসংখ্যক বিজ্ঞাপন পেতে আপস করা হচ্ছে বিজ্ঞাপনমূল্যের সঙ্গেও। যদিও অনুষ্ঠানের মানোন্নয়নের দিকে মনোযোগ সেভাবে না দেয়ায় চ্যানেলগুলো দর্শক আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ক্যাবল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) হিসাবে, দর্শকরা দেশী চ্যানেল দেখছে মাত্র ২০ শতাংশ সময়। ৭০ শতাংশ সময়ই তারা ভারতীয় চ্যানেল দেখছে। বাকি ১০ শতাংশ সময় তারা দেখছে অন্যান্য দেশের চ্যানেল।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেলের জনপ্রিয়তা অসম্ভব বাড়িয়ে দিয়েছে ডেইলি সোপের মতো অনুষ্ঠানগুলো। দেশের নারী দর্শকের কাছে অন্য যে কোনো অনুষ্ঠানের চেয়ে ডেইলি সোপগুলোই বেশি পছন্দের। বিশেষ করে গৃহিণীদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় ভারতীয় চ্যানেলের এসব সিরিয়াল। তারাই শুধু নয়, ডেইলি সোপের নিয়মিত দর্শক পরিবারের পুরুষ সদস্য এমনকি শিশুরাও।
সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশী চ্যানেলগুলো যেসব অনুষ্ঠান প্রচার করছে, তার মধ্যে জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে এগিয়ে আছে সংবাদ। এর পরই রয়েছে নাটকের দর্শক। দর্শকপ্রিয়তায় এর পরের স্থানগুলোয় আছে যথাক্রমে ম্যাগাজিন, চলচ্চিত্র, প্রতিবেদনভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও টকশো। তবে এসব অনুষ্ঠানের মান নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।
নাট্য নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম বলেন, ‘আমাদের বাজারের যে পরিধি, বর্তমানে একই ধরনের টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। ইদানীং যে পরিমাণ বিজ্ঞাপন চ্যানেলগুলোর মধ্যে ভাগ হয়, সেজন্য যতসংখ্যক টিভি অনুষ্ঠানের প্রয়োজন, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে সে অনুযায়ী মানসম্মত শিল্পী, নির্মাতা ও কলাকুশলী আছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়া সঠিক নির্মাতাকে যদি প্রয়োজনমতো বাজেট দেয়া না হয়, তাহলে কিন্তু মানসম্মত নাটকটি তিনি নির্মাণ করতে পারবেন না। ফলে আগ্রহী দর্শকও চ্যানেলটি দেখবে না।’
এ নির্মাতা বলেন, ভালো কাজ করার জন্য বেশি বাজেট ও স্থির লোক দরকার। এ দুটো বিষয়ের সন্ধি হচ্ছে না। তাই মানসম্মত প্রডাকশন দাঁড়াচ্ছে না। দর্শকও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
জানা গেছে, ১৯৬৪ সালে টেরেস্ট্রিয়াল চ্যানেল হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ টেলিভিশন যাত্রা করে। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে শুরু হয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল। এর পর থেকে নতুন নতুন চ্যানেল আসতে থাকে। বড় হতে থাকে এর বাজার। এ বাজার দখল করতেই চ্যানেলগুলোর মধ্যে মানহীন এ প্রতিযোগিতা।
অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্সের (অ্যাটকো) সাধারণ সম্পাদক ও চ্যানেল আইয়ের পরিচালক শাইখ সিরাজ বলেন, বাজার দখলে অনুষ্ঠানের চেয়ে বিজ্ঞাপন প্রদর্শনকেই বেশি গুরুত্ব দেয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। তাছাড়া মনগড়া ও বিজ্ঞানবিরুদ্ধ বিজ্ঞাপনও প্রদর্শিত হচ্ছে। দর্শক এতে বিভ্রান্ত হচ্ছে। তাছাড়া টিকে থাকার জন্য নিজস্ব মতামতের চেয়ে বিজ্ঞাপনদাতাদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে অনুষ্ঠান সাজাতে হচ্ছে। দেশী-বিদেশী চ্যানেলগুলোর সম্প্রচারের ক্ষেত্রে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন রয়েছে।
বিদেশী চ্যানেল প্রভাব বিস্তার করায় দেশী চ্যানেলগুলো বাণিজ্যিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভারতীয় চ্যানেলগুলো আমাদের দেশের দর্শক চাহিদা অনুযায়ী অনুষ্ঠান সম্প্রচারের মাধ্যমে দর্শকপ্রিয়তা পাচ্ছে। বিজ্ঞাপন প্রচারের গতানুগতিক ধারায়ও তারা পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু দেশী চ্যানেলগুলো সেভাবে বিদেশে প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না। এটাই আমাদের প্রধান দুর্বলতা।’
টেলিভিশন চ্যানেলে বিজ্ঞাপন প্রদর্শনের নীতিমালা রয়েছে জানিয়ে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, বাজার দখলের জন্য আইনের বাইরে গিয়ে কোনো টেলিভিশন চ্যানেলের বিরুদ্ধে বিজ্ঞাপন প্রদর্শনের অভিযোগ উঠলে প্রমাণসাপেক্ষে এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
এ ধরনের অভিযোগ মাঝ্যে মধ্যে পাওয়া যায় জানিয়ে তিনি বলেন, অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট চ্যানেলকে সতর্কও করা হয়।
দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠানের মধ্যে সংবাদ অন্যতম জনপ্রিয় হলেও এক্ষেত্রে আরো উন্নতির সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। তাদের মতে, টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এখনো রাজনৈতিক ও রাজধানীকেন্দ্রিক সংবাদ পরিবেশনকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। স্থানীয় সংবাদ সে অনুপাতে গুরুত্ব পায় না। চ্যানেলগুলো এদিকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং বিজ্ঞাপন পাওয়ার দিকেই বেশি মনোযোগী।
বিজ্ঞাপনকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে নীতি বিসর্জন দেয়া মোটেই কাম্য নয় বলে মনে করেন আরটিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ আশিক রহমান। তিনি বলেন, বাজার বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিযোগিতাও বাড়ছে। তবে বাজার দখলের জন্য বিজ্ঞাপনকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে নীতি বিসর্জন দেয়া মোটেও কাম্য নয়। অনুষ্ঠান প্রচারের মান বাড়িয়ে দর্শক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারলে বিজ্ঞাপনদাতারা এমনিতেই বিজ্ঞাপন দেবেন। অনেকে প্রয়োজনীয় পুঁজি না নিয়ে চ্যানেল শুরুর কারণেও পরিচালন ব্যয় মেটাতে গিয়ে বিজ্ঞাপনের বাজার দখলের অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হচ্ছে।
সুত্র: দৈনিক বণিক বার্তা :: বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৪ ইং | ৬ অগ্রহায়ণ ১৪২১ বঙ্গাব্দ