ডেস্ক : ২০০৯ সালের ৬ জুন শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এর পর দীর্ঘ ১৭ বছর চলে গেছে, এর মধ্যে একটানা ১৫ বছর তিনি ছিলেন দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এসময় তথাকথিত গণতন্ত্রের মানসকন্যা থেকে তিনি পরিণত হয়েছেন এই শতাব্দীর অন্যতম ঘৃণিত এক স্বৈরাচারী শাসকে। কিন্তু কেমন ছিল তার শাসনকাল? তিনি কি আসলেই বাংলাদেশকে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসিয়েছিলেন, যেমনটা তার কর্মী-সমর্থকরা মনে করেন? নাকি জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার অধিকার হরনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ?
আসুন, আজ এ বিষয়ে একটু আলোকপাত করা যাক।
হাসিনার আমলে বাংলাদেশের মানুষের সামনে মূলত দুটো পথই খোলা ছিল,হয় উন্নয়নের বয়ান মেনে নাও, নয়তো চুপ করে থাকো!
প্রায় দেড় যুগ ধরে বাংলাদেশের উন্নয়ন মডেলের এক অলীক একপেশে প্রচার চালিয়ে গেছে শেখ হাসিনার সরকার। নিজস্ব অর্থায়নে বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, অসংখ্য রাস্তাঘাট-ফ্লাইওভার, বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিসংখ্যান কিংবা ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মান, এমন প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর উন্নয়নের বয়ান ছিল আকাশচুম্বী। কিন্তু এই উন্নয়নের আড়ালে ছিল শুভঙ্করের ফাঁকি। সেই সাথে গণতন্ত্রের নামে মূলত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত একনায়কতন্ত্রই গড়ে তুলেছিলেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।
হাসিনার মন্ত্রীরা বলতেন যে, তাঁরা বাংলাদেশের জিডিপি ২০০৯ সালে মাত্র ১০২ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৩ সালে ৪৬০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করেছেন। শুনতে সত্যিই ভালো লাগে! কিন্তু এটি একটি বিভ্রান্তিকর মিথ্যাচার।
অর্থনীতিতে যখন মেগা প্রকল্পগুলোর ব্যয় অযৌক্তিকভাবে বেশি হয়, তখন জিডিপি স্বাভাবিক ভাবেই বেড়ে যায়। কিন্তু এর ফলে জনগণের জীবনমান উন্নত হয় না, বরং তাদের জীবনযাপনের ব্যয় আরও বাড়ে।
আবার জিডিপি বাড়িয়ে দেখানোর কিছু পদ্ধতিগত কূটকৌশলও আছে। আর ১৫ বছর আগের জিডিপির সঙ্গে বর্তমানের তুলনা করে আপনি বড় সাফল্য দাবি করতে পারেন না। সরকারের সফলতা বা উন্নয়নের তুলনা করতে হলে বছর ধরে প্রবৃদ্ধির হার হিসাব করতে হবে।
শেখ হাসিনা ও তাঁর দলের নেতাদের ভাষ্যমতে তাঁদের আমলে বাংলাদেশি মানুষের গড় আয় তিন গুণ বেড়েছে। সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো হয়েছে শতভাগ, বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও ন্যূনতম একটা মানদণ্ড নিশ্চিত করা হয়েছে। এটা সত্যি কথা, তবে এই সময়ে জিনিসপত্রের দামও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে, সত্যি বলতে কি আয়ের চেয়ে অনেক বেশিই বেড়েছে।
বাংলাদেশের গৃহস্থালি আয় ও ব্যয় সমীক্ষা ২০২২ প্রতিবেদন থেকে কিছু হিসাব দেখা যাক। ২০১০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ১২ বছরে গড় গৃহস্থালি আয় ১১৪৭৯ টাকা থেকে বেড়ে ৩২৪২২ টাকায় পৌঁছেছে। অর্থাৎ এই সময়ে মানুষের আয় বেড়েছে ২ দশমিক ৮ গুণ।
কিন্তু এই সময়েই ভোক্তা মূল্যসূচক অনুযায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ২ দশমিক ১৬ গুণ বেড়েছে এবং পাশাপাশি দৃষ্টিকটু ভাবে বেড়েছে আয়বৈষম্য। সহজ ভাষায় বলা যায়, এসময় ধনীরা আরও ধনী হয়েছে, গরীবরা নেমে গেছে তলানিতে আর বেড়েছে দরিদ্র জনগোষ্ঠী।
অনেকেই অবকাঠামো খাতে শেখ হাসিনার অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। কর্ণফুলী টানেল বা ভাড়া ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো কয়েকটি অলাভজনক প্রকল্পের কথা বাদ দিলে, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল প্রকল্পের সুফল মানুষ পাচ্ছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে এই মহাপ্রকল্পগুলোর সাথে যে বিপুল ঋণের বোঝা আর দূর্নীতি জড়িত সেটা তো এখন সবাই জানে। সত্যিটা হলো, শেখ হাসিনার সময়ে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জিত হয়েছিল, তা ছিল ঋণ করে ঘি খাওয়ার নির্মম উদাহরণ!
উল্লেখ্য যে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের সময় বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মোট স্থিতি ছিল ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অথচ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার দিনে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা!
আর মনে রাখতে হবে, সেতু, রাস্তা বা অবকাঠামো গড়ে তোলা একটা দেশের চলমান প্রক্রিয়া। এটা সব সরকারকেই করতে হয়। নইলে তো দেশের অর্থনীতির চাকাই থেমে যাবে।
ক্ষমতার বিষয়টি তীব্রভাবে শাসকের মনস্তত্ত্বের সঙ্গে যুক্ত। যখন একজন নেতার আত্মমগ্নতা এবং প্রতিশোধস্পৃহা একটি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ করতে শুরু করে, তখন রাষ্ট্র আর জনগণের থাকে না, হয়ে ওঠে সেই নেতার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে ঠিক এটাই ঘটেছে। ১৯৭৫-এর মুজিব হত্যাকাণ্ড শুধু ব্যক্তিগত শোক ছিল না, এটি পরিণত হয়েছিল তাঁর রাজনৈতিক দর্শনে। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত কে তিনি মনে করতেন ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক। এর ফলে বাংলাদেশের রাজনীতি আর ক্ষমতার পালাবদলের সুষ্ঠু গণতন্ত্র দেখেনি, বরং পরিণত হয়েছে এক নৈতিক যুদ্ধে, এক প্রতিশোধের গল্পে।
এজন্যই শেখ হাসিনার সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারের মতো একটি নৈতিকভাবে অপরিহার্য প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে অবলীলায়।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অন্যতম গুরুতর অভিযোগ হলো বাংলাদেশে ইতিহাসের জঘন্যতম কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রতিষ্ঠা৷ কর্তৃত্ববাদী শাসনের মূল ভিত্তি হলো ব্যক্তিপূজার সংস্কৃতি নির্মাণ করা, যেটা তিনি খুব সফলতার সাথেই করতে পেরেছিলেন। নিজেকে জাতির ত্রাণকর্তা এবং ইতিহাসের অনিবার্য নায়ক হিসেবে টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁর প্রয়োজন ছিল অবিরাম প্রশংসা ও প্রশ্নাতীত আনুগত্য। শেখ হাসিনার শাসনামলে এই প্রকল্পই রাষ্ট্রীয় এবং দলীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাস্তবায়িত হয়েছে। এসময় তাঁকে ‘উন্নয়নের রূপকার’, ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ থেকে ‘মানবতার মা’ কতই না বিশেষণে মহিমান্বিত করা হয়েছে।
প্রচারযন্ত্রের মাধ্যমে এমন এক বাস্তবতা তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ইচ্ছাই হয়ে উঠেছিল রাষ্ট্রের স্বার্থ। তাঁর পিতার ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে এই ব্যক্তিপূজাকে এক আবেগী ও নৈতিক বৈধতা দেওয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে তাঁর সমালোচনা এবং রাজনৈতিক ভিন্নমত পরিণত হয়েছিল ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ বা ‘জাতির পিতার অবমাননা’র মতো অমার্জনীয় অপরাধ।
যুগে যুগে স্বৈরশাসকরা এভাবেই নিজেকে মহিমান্বিত করেন, ব্যক্তিগত সহমর্মিতা বা জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠা করেন কঠোর নিয়ন্ত্রণ।
এই একই কৌশল আমরা দেখি তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন বা এরকম আরও অনেকে নেতার মধ্যেই। তবে তাদের সাথে হাসিনার পার্থক্য হলো, তিনি তাঁর সীমারেখা ভুলে গিয়েছিলেন বা আদৌ গ্রাহ্য করেন নি।
তাঁর তথাকথিত উন্নয়নের জোয়ারের একরৈখিক প্রচারণা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, এর আড়ালে চাপা পড়ে গেছে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব, আয়বৈষম্য এবং সাধারণ মানুষের দীর্ঘশ্বাস।
তিনি একদলীয় শাসনব্যবস্থায় আইনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন, আবার সেটার সপক্ষে নির্লজ্জ সাফাই দিয়েছেন। এই নির্লজ্জ অহমিকার সবচেয়ে ভয়ংকর দিকটি হলো, এই নৈতিক অবক্ষয় ক্যানসারের মতো পুরো সমাজেই ছড়িয়ে পড়েছিল। আওয়ামী ঘরানার বাইরের মানুষগুলো যেন মানুষই ছিল না, ছিল কোনো খামারের পশু যাদের কোন স্বাধীন ইচ্ছা বা অধিকার নেই।
যেভাবে তিনি গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গায়েবি মামলার পদ্ধতিগত প্রয়োগ করেছেন, শিক্ষার্থীদের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে ব্যঙ্গ করেছেন, সেটাকে দমন করার সম্ভাব্য সব ধরনের অপপ্রয়াস চালিয়েছেন, তাতে করে বাংলাদেশ পরিণত হয়েছিল এক ব্যর্থ রাষ্ট্রে, যে রাষ্ট্র বাইরে থেকে দেখতে ছিল উন্নয়নের আলোকসজ্জায় উজ্জ্বল, কিন্তু ভেতরে ছিল ভয়, বিভাজন ও গভীর নৈতিক ক্ষরণে পরিপূর্ণ বিস্ফোরণের অপেক্ষায়।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলন ছিল সেই অপেক্ষার বুদ্বুদ ফেটে যাওয়ার মুহূর্ত।
একটি দেশ যখন শাসকের আত্মমগ্নতা আর নিয়ন্ত্রণের শিকার হয়, তখন জাতির আত্মাটাই কলুষিত হয়ে যায়, যার উদাহরণ আমরা এখনো চারপাশে দেখতে পাচ্ছি।
এই কলুষতা থেকে মুক্তির প্রক্রিয়া হতে পারে এক দীর্ঘ ও যন্ত্রণাদায়ক পথ।



